গ্রীক দার্শনিক ও গণিতবিদ পিথাগোরাস (৫৭০-৪৯৫খ্রিস্টপূর্বাব্দ )একজন বিখ্যাত দার্শনিক। পিথাগোরাসের নাম শোনেননি এমন শিক্ষিত মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তিনি পিথাগোরীয় সম্প্রদায় গঠনের মাধ্যমে সম্পূর্ণ নতুন এক ধরনের ভাবের জন্ম দিয়েছিলেন। তার রাজনৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা "ম্যাগনা গ্রেসিয়া" নামে পরিচিত।
পোস্ট সূচীপত্রঃ
মনে করা হতো তিনি প্লেটো ও অ্যারিস্টটলকে প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন, যার ফলে পশ্চিমা বিশ্ব জ্ঞানের আলোকিত হতে পেরেছিল। তবে আধুনিক যুগের পণ্ডিতগণ এসব কথা বিনা বাক্যে মেনে নেননি। পিথাগোরাসের নামে প্রচলিত জীবন দর্শনের অমোঘ সত্য বাক্যগুলোকে পিথাগোরাসের কথা হিসেবে ধরে নেয়াটা সম্ভবত দোষের হবে না। সুতরাং ধরে নিচ্ছি যা বলা হবে সেগুলো মহান গণিতবিদ ও দার্শনিক পিথাগোরাসের কথা।
পিথাগোরাস সম্পর্কে কিছু কথা
পিথাগোরাসের পুরো জীবনটাই বহু কিংবদন্তি ও রহস্য দ্বারা আচ্ছন্ন ছিল। তার লেখালেখিগুলোর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। কারো কারো মতে তাঁর অনুসারীরা পরবর্তী সময়ে তাঁকে আধা ঈশ্বরে পরিণত করেছিল। তিনি এক ধর্ম সম্প্রদায় তৈরি করেছিলেন, সেখানে অনু শাসনও তৈরি করেছিলেন। তবে একথা সত্যি যে, তিনি একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছিলেন, যার মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞানের শিক্ষা দিয়েছেন। পিথাগোরাসের নামে প্রচলিত বেশ কিছু কথাবার্তা পাওয়া যায়, যেগুলো বেশ চিন্তা উদ্ভাবনকারী। জীবন দর্শন ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নির্যাসের পরিচয় পাওয়া যায় উক্তিগুলোতে। সেগুলোতে রয়েছে জীবনের কঠিন সংকটের সহজ মীমাংসার পরিচয়।
বয়স বাড়লে প্রজ্ঞা তৈরি হয়
গ্রিক দার্শনিক ও গণিতবিদ পিথাগোরাস মনে করতেন,বয়স বাড়লে প্রজ্ঞা তৈরি হয় । অর্থাৎ ব্যাপক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে বিশেষ দৃষ্টি তৈরি হয়। তার শিক্ষা হলো সম্পদ মানে টাকা পয়সা নয়,প্রকৃত সম্পদ হচ্ছে চিন্তাকে সমৃদ্ধ করা। তিনি মনে করেন, চরিত্র ও আত্মনিয়ন্ত্রণের মতো সদগুনগুলো সুনামের থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর কালজয়ী বাণীগুলোতে পরিচয় মেলে সূক্ষ্ম বিশ্লেষনদৃষ্টির। তিনি বলেন সম্পর্ক তৈরি হয় বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে। তিনি জ্ঞানীকে বিনয়ী হওয়ার শিক্ষা দেন এবং সৎ জীবনযাপনের মাধ্যমে সুখি হওয়ার পরামর্শ প্রদান করেন। তাঁর পর্যবেক্ষণলব্ধ এসব বাক্য আমাদের জীবনে, চিন্তায় বিবিধ অভিঘাত তৈরি করতে পারে এই সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনাটির সূত্রপাত ।
প্রজ্ঞার মূল্য তারুণ্যের শক্তির চেয়ে অবশ্যই বেশি
পিথাগোরাস বলেন যে, মানুষের বয়স বাড়লে তার অভিজ্ঞতা বাড়ে। জন্ম নেয় প্রজ্ঞা। অমিত শক্তি ও কর্মস্পৃহা আছে তরুনদের। কিন্তু অভিজ্ঞতার বড়ই অভাব তাদের। সময়ের প্রক্ষাপটে শক্তিকে কিভাবে কাজে লাগাতে হবে সেটা না জানলে অসংখ্য সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। পিথাগোরাস তরুনদের প্রচুর জ্ঞান অর্জন করতে বলেছেন। তাদের অনেক সতর্ক হতে বলেছেন। তাদের বিনয়ী থাকতে বলেছেন। বয়স যত বাড়ে ততই জ্ঞানে সমৃদ্ধ হয় আমাদের জীবন। কিন্তু তরুণদের এমন বহুদর্শনের অভিজ্ঞতা থাকে না। পিথাগোরাস পরামর্শ দিয়েছেন যে, তরুণরা যেন অভিজ্ঞ বৃদ্ধ মানুষদের সাথে গল্প করে, যেকোন বিষয় আলোচনা করে, তাদের পরামর্শ নেয়। কারন একজন মানুষ অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এমন জ্ঞান অর্জন করে যা অনেক কার্যকর হয়।
সহজ সরল জীবনেযাপনের মাধ্যমেই আসে প্রকৃত সুখ
কালজয়ী দার্শনিক পিথাগোরাস আমাদের বলেছেন যে, সহজ সরল জীবনযাপনের মাধ্যমে আমরা প্রকৃত সুখ অর্জন করতে পারি। একজন মানুষের যত বেশি ধন সম্পদ থাকুক না কেন অপচয় ও সীমাহীন চাহিদা জীবনে সস্তি নষ্ট করে, মানসিক চাপ বৃদ্ধি করে, জীবনে অসন্তোষ সৃষ্টি করে।
কিন্তু স্বল্প উপকরন দিয়ে সহজ সরলভাবে আমাদের প্রয়োজনীয় আকাঙ্খার নিবারন সম্ভব এবং এভাবে আমাদের জীবনে সস্তি ও শান্তি মেলে। সম্পদের বিবেচনা হওয়া উচিত অন্তরের সুখ, শান্তির উপর ভিত্তি করে, বহু কিছুর মালিক হওয়া বা দখলে রাখার মধ্য দিয়ে নয়। সাধারণ ও প্রয়োজনীয় উপকরণ দ্বারা সহজ সরল জীবনযাপন আমাদেরকে বৃহৎ কোন উদ্দেশ্য সাধনে গভীর ভাবে মনোযোগী হতে সাহায্য করে।
বন্ধুরা হল আমাদের নিজেদের বেছে নেয়া পরিবার
পিথাগোরাসের মতে, বন্ধুরা কখনো কখনো আত্মীয়তার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়। বন্ধুত্বের বন্ধন তৈরি হয় উভয়ের কিছু সদ গুনের উপর। যেমন- বিশ্বস্ততা আনুগত্য ও সহমর্মিতা। আমরা আমাদের পরিবারকে বাছাই করে নিতে পারি না বরং পরিবারে জন্মাই বলে পরিবারের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হই। কিন্তু আমরা সচেতনভাবে বন্ধুদের বেছে নিতে পারি। আশেপাশের এমন মানুষ আমাদের পাশে থাকলে আমাদের কর্ম শক্তি ও মনের সমৃদ্ধি। বিপদের দিনে বন্ধু পাশে থাকে সহমর্মী হয়, সুখেন দিনে আনন্দের অংশ হয়ে ওঠে। অন্তরঙ্গ বন্ধুত্বের সম্পর্ক পারস্পরিক আস্থা ও সহমর্মিতায় পরিপূর্ণ হলে তা পারিবারিক সম্পর্কের মতই আন্তরিক হয়ে ওঠে।
আমাদের জ্ঞানের মধ্যেই প্রকৃত সম্পদ নিহিত আছে।
পিথাগোরাস মনে করতেন যে প্রকৃত সম্পদ বস্তুগত অর্জনে নয় বড় মনের সমৃদ্ধিতে জ্ঞান অর্জনে অর্জিত হয়। জ্ঞান অন্বেষণই সবচেয়ে বেশি কামনার বস্তু হওয়া উচিত। আমাদের চারপাশের পৃথিবীকে গভীরভাবে জানা ও বোঝার মাধ্যমে শিক্ষা অর্জন করা সম্ভবপর হলে তা মানবীয় সম্ভাবনাগুলকে প্রস্ফুটিত করতে পারে । জগতের অর্থ সম্পদ অন্তরে সন্তুষ্টি দিতে পারেনা বরং জ্ঞান ও যুক্তির যথাযথ চর্চা জীবনের উদ্দেশ্যকে অর্থ দিতে সক্ষম হয়। বিজ্ঞান যুক্তি প্রজ্ঞার ভান্ডার সকলের জন্য উন্মুক্ত ও উন্মোচিত। এই জ্ঞানের ভান্ডার কখনো শেষ হয় না, তাই অন্বেষণকারীর অর্জন কখনো শেষ হয়ে যায় না।
চরিত্র অবশ্যই সুনাম অপেক্ষা বেশি গুরুত্বপূর্ণ
দিক দার্শনিক ও গণিতবিদ পিথাগোরাসের শিক্ষার মূল কথা হলো সকল ক্ষেত্রে সংযমী হওয়া। অতিরিক্ত চাহিদা ও অপচয়কে তিনি নীরুৎসাহিত করেছেন। অতিরিক্ত খাবার অনেক বেশি ঘুম মাত্রাতিরিক্ত কাজ আমাদের জীবনের ভারসাম্য নষ্ট করে। ভালো জিনিসও অতিমাত্রায় ব্যবহার ব্যবহারের কারণে খারাপ পরিণতি হতে পারে। সঠিক পরিমাপ ও নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা লোভ লালসা আলস্য ও বিভ্রম থেকে মুক্তি পেতে পারি। মধ্যপন্থা অবলম্বন জীবনের সকল কাজে সকল ক্ষেত্রে সুবিবেচিত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে।
যত বেশি জ্ঞান অর্জন করি নিজের অজ্ঞানতাকে তত বেশি আবিষ্কার করি
আমি অধিক জানি এই দম্ভকে পিথাগোরাস দূরে সরিয়ে দিতে বলেছেন । যারা প্রকৃত জ্ঞানী বিনয়ী হয় এবং বিশাল জ্ঞান যাদের সমুদ্রের কূলকিনারা তার জানা নেই, এ কথা সহজে স্বীকার করে। যতই আমাদের জ্ঞান বাড়ে ততই আমরা বুঝতে পারি যে আমাদের অজানা সীমাহীন । জগতের অনেক জটিল ও অসীম জ্ঞানের রাজ্যে আমাদের অবস্থান অতি ক্ষুদ্র। জ্ঞান আরোহণের মাধ্যমে চিত্তের প্রসারতায় মানুষের দৃষ্টির পরিসীমা প্রসারিত হয়। আমাদের বহু বিষয়ে জানার বাকি, শেখার বাকি একথাগুলো স্বীকার করে নেয়াই হচ্ছে প্রজ্ঞা লাভের প্রথম ধাপ। এই মানসিকতা আমাদের জ্ঞানানুসন্ধানী মানুষে পরিণত করে। সবজান্তা প্রদর্শনকারী ব্যক্তির মেকি আত্মপ্রদাস চোখে এক ধরনের পট্টি বেঁধে দেই। জ্ঞানের মিথ্যা অহংকার জ্ঞানী ব্যক্তিকে কুপমন্ডূক অচল বস্তুতে পরিণত করে।
শেষকথা
মানুষের সম্মিলিত কর্মগুলোর কাল ক্রমিক প্রচেষ্টাই যে পৃথিবীর নির্মাণ সম্ভব হয়েছে তার ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব সংরক্ষণ মানুষকে নিশ্চিত করতে হলে মন ও মস্তিষ্কের শুদ্ধাচার অতীব প্রয়োজন। পিথাগোরাসের অনুশাসনগুলো হচ্ছে তার প্রবর্তিত এথিকস। সময় ও কালক্ষেপের পরিবর্তনে এথিকসের পরিবর্তন হতে পারে, কিন্তু পৃথিবীর মানুষ এথিকস শূন্য হতে পারে না। যিনি কর্ম সাধনায় নিবিষ্ট হয়ে নিজের আত্মকে অবজ্ঞা করেছেন, যিনি সম্পদ প্রতিষ্ঠার মোহে একেবারে অন্ধ হয়ে অসদুপায় অবলম্বন করে নিজের স্বস্তি নষ্ট করেছেন, যিনি নিজের পরিবার আত্মীয়তার সম্পর্ককে মূল্যহীন ভেবে, সেই সম্পর্ক গুলো অস্বীকার করে লাভবান হতে চেয়েছেন, যিনি বস্তুগত অর্থহীন অর্জন ও কামনা লালসা মিটাতে গিয়ে নিজেকে একটা শূন্য খোলসে পরিণত করেছেন- সেই সকল ভ্রমাকুল মানুষ পিথাগোরাসের পদ্ধতি গুলো অনুসরণ করে নিজেদের ভুল শুধরাতে পারেন। বহু ধর্ম ও বিভিন্ন নৈতিক বিধানের মধ্যেও এ বাক্যগুলোর সন্ধান মিলে। ধর্মকে লালন করেছে যে মানুষ,ধর্ম তাকেই নির্মাণ করেছে। মানুষ হয়তো বিশ্বাস থেকে মুক্তি স্বাধীনতা লাভ করতে পারে, কিন্তু মানুষের অন্তর্নিহিত যে স্বাধীন ও সুন্দর সত্তা আছে, তাকে প্রতিস্থাপিত করতে হয় আরো উন্নত নৈতিক বিধানের মাধ্যমে।
আপনার জ্ঞানের আলোকে প্রসারিত করার লক্ষ্যে তথ্যগুলো সংগ্রহ করে আপনার সম্মুক্ষে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমার লেখার দ্বারা আপনার জ্ঞানচর্চায় সামান্যতম মাত্রা যোগ হলেও আমার লেখাটি সার্থক হবে। যদি আমার লেখাটি ভালো লেগে থাকে অথবা আমার লেখায় কোনো ভুল ভ্রান্তি হয়ে থাকে তবে কমেন্ট বক্সে অবশ্যই জানাবেন।
ট্রাসটেডএয়ার্ডের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url